কুরআনে বর্ণিত তীন ফল : একটি ভ্রান্তির অপনোদন
সুরা তীনের প্রথম আয়াতেই দুটো ফলের আলোচনা। আল্লাহ সেগুলোর নামে শপথ করেছেন। এক. ত্বীন, দুই. যায়তুন। আমরা যখন বাংলা ভাষায় এ দুটো শব্দের অর্থ করি তখন একটা ঝাপসা অর্থ দাঁড় করাই। মোটামুটি সব অনুবাদে তীনকে চিরচেনা ডুমুর আর যায়তুনকে যায়তুন হিসাবেই দেখানো হয়েছে। এগুলোর আসল চিত্রপট অধিকাংশ অনুবাদকেরা আঁকেন না। ফলে অপ্রত্যাশিত ভ্রান্তিতে পাঠকেরা থেকে যাচ্ছেন। যেমন: যায়তুনকে অনেকেই জলপাই বলে চালিয়ে দেন। আসলেই কি যা যায়তুন তা-ই জলপাই? না, দুইয়ের মাঝে ভিন্নতা সুস্পষ্ট। সে আলোচনা অন্যদিন। আজ আমি শুধু তীন নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
তীন আর আমাদের দেখা ডুমুর
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, কুরআনে যে তীনের উল্লেখ রয়েছে তা আমাদের দেশে নেই। এ দেশীয় মানুষদের কাছে অপরিচিত এক ফল। অথচ আমাদের বন-জঙ্গলে বা বাড়ির বাগানে গজে উঠা কাকডুমুরের সাথে আমরা তা মিলিয়ে ফেলি। কাকডুমুর আর তীন যে এক নয় তা কিন্তু অনেকেই জানি না। বাংলাদেশে যে ডুমুরের দেখা মেলে সেটির বৈজ্ঞানিক নাম ফাইকাস হিসপিডা (Ficus hispida)। ঝোঁপ গাছ, পাতা সিরিস কাগজের মতো খসখসে। শুধুমাত্র পাখিরাই প্রধানত এই ডুমুর খেয়ে থাকে এবং পাখির বিষ্ঠার মাধ্যমে বীজের বিস্তার হয়ে থাকে। মানুষের খাওয়ার একদমই অনুপযুক্ত। আমাদের দেশে এর চাষাবাদ করতে হয় না। অবহেলা আর অযত্নে বেড়ে উঠে। একে অনুপকারী বলা হয়ে থাকে। সুতরাং তীন তিলাওয়াত করার সময় দেশীয় ডুমুরের কল্পনা মাথায় নিলে কিন্তু অর্থচ্যুতি ঘটবে নিশ্চিত। দীর্ঘদিনের ধারণা এখনই বাদ দিতে হবে।
তীনের পরিচয়
কুরআনে যে তীনের কথা উল্লেখ রয়েছে সেটির বৈজ্ঞানিক নাম Ficus carica। ফাইকাস দলভুক্ত ৮০০ প্রজাতির মধ্যে এই তীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবার আগে স্থান। এটি দেশীয় কাকডুমুর থেকে বড়। স্বাদে সুমিষ্ট, অত্যধিক সুস্বাদু এবং রসালো। এককথায়, স্বাদে, ঘ্রাণে এবং পুষ্টিগুণে সেরা একটি ফলের নাম তীন। তীন গাছ তিন থেকে দশ মিটার পর্যন্ত বড় হয়। ঘন এবং খসখসে পাতায় ভরপুর থাকে। উর্দুতে এর ফলকে আঞ্জির বলা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে এর চাষাবাদ হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম এশিয়ায় এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয় এবং এটি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। আফগানিস্তান থেকে পর্তুগাল পর্যন্ত এই ফলের বাণিজ্যিক চাষ হয়ে থাকে। এর আদি নিবাস মধ্যপ্রাচ্য। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় তুরস্কে। বৎসরে তিন লক্ষ টনের বেশি উৎপাদন হয় সেখানে। পরেই আছে মিশর, মরক্কো, আলজেরিয়া, ইরান এবং সিরিয়া।
তীনের পুষ্টিগুণ
তীনে আছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-কে, ভিটামিন-বি, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিংক, কপার, আইরন ইত্যাদি।
এতকিছু উপকারী উপাদান থাকলেও ক্যালরি এবং ফ্যাট নেই বললেই চলে। মোটা হয়ে যাওয়ার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে পেটভর্তি খাওয়ার মতো একটি ফল তীন। বড় সাইজের একটি তীনে মাত্র ২ গ্রাম ফ্যাট থাকার কথা খাদ্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন। ডায়েটেড এবং ফিট থাকতে চাইলে তীন সবচেয়ে কার্যকর ফল। আর এন্টিঅক্সিডেন্ট-এর তীনের চেয়ে ভালো ফল আর নেই বললেই চলে।
প্রোস্টেট এবং জরায়ু ক্যান্সারের প্রতিষেধক হচ্ছে তীন। ব্লাড প্রেসার এবং স্নায়ুরোগ কমাতে দারুণ কার্যকর। মায়ের বুকে দুধ উৎপাদনে তীনের জুড়ি মেলা ভার। পাইলসে ভোগা ব্যক্তিরা অসাধারণ ঔষধ হিসাবে তীন খেতে পারেন। গরুর দুধে এলার্জি থাকলে তীন খান। ক্যালসিয়ামের ঘাটতি নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।
ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ, হাঁপানি রোগ, শ্বাসকষ্ট, ত্বক সমস্যা, চুলের রোগে তীন সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। গর্ভবতী মহিলাদের এসিডিটি নির্মূল করে তীন। কিডনি, লিভার, ইউরিনারি ব্লাডারের কার্যকারিতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে। শরীরের দুর্বলতা দূর করে আনে সজীবতা আর অদম্য শক্তি। তীন ফলের উপকারিতা লেখতে চাইলে শেষ করা কষ্টকর হয়ে যাবে।
আল্লাহর রাসুল (সা.) তীন ফল অনুসারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার সময় বলতেন, ‘এটি খাও, কারণ এতে অনেক রোগের ঔষধ রয়েছে।’
সুতরাং তীনের তরজমা শুধুমাত্র ডুমুর দিয়ে যারা করেন তারা একটা ভুল অর্থ দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। এ দেশীয় মানুষদের মগজে এমন একটি ফলের চিত্র এঁকে দেয়া হচ্ছে যা মানুষের খাওয়ার একদম অনুপযোগী। পাখপাখালির খাবার শুধু। এমনকি ডুমুরের নাম শুনলে অনেকে বিরক্তিভাব প্রকাশ করেন।
তীনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Fig। আর এই তীন এদেশের মানুষের কাছে একদমই অপরিচিত এক ফল।
আমাদেরকে কুরআনিক শব্দ নিয়ে গভীরে ডুব দিতে হবে। ভাবতে হবে মনোযোগে। তারপর মুক্তা তুলে তা প্রচার করতে হবে।
আল্লাহ যে ফলের শপথ করেছেন তা যেনতেন কোনো ফল নয়। অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উপকারী তো বটেই।
Reviews
There are no reviews yet.